ভারতের মুম্বাইয়ে ১৯৯৩ সালে ধারাবাহিক বিস্ফোরণের মূল পরিকল্পনাকারী ইয়াকুব মেমনের ফাঁসি গতকাল কার্যকর করা হয়েছে। রাতভর নানা নাটকীয়তার পর অবশেষে সকাল ৭টার দিকে বহুল আলোচিত এ দ- কার্যকর করা হয়। মহারাষ্ট্র রাজ্যসরকার বিষয়টি নিশ্চিত করেছে। রাজ্যের নাগপুর কারাগারে মেমনের ফাঁসি কার্যকর হয়। স্মরণকালের ভয়াবহ ওই হামলা ২৫৭ জন নিহত ও ৭০০ জন আহত হয়েছিলেন। খবর বিবিসি, এনডিটিভি, জি নিউজের।
ফাঁসির আগে মেমনের কাছে কারা কর্তৃপক্ষ তার শেষ ইচ্ছার কথা জানতে চাইলে জানায়, তার মেয়ের সঙ্গে দেখা করতে চায়। ইয়াকুবের ভাইয়ের তথ্য অনুসারে কারা কর্তৃপক্ষ ২১ বছর বয়সি মেমনের মেয়ের সঙ্গে তার ফোনে কথা বলার ব্যবস্থা করে। এদিকে গতকাল ফাঁসি কার্যকরের পর পরই তার মরদেহ মুম্বাইয়ে নিয়ে আসা হয়। সেখানে বাদা কবরস্থানে তার লাশ দাফন করা হয়।
ভারতে মৃত্যুদ- কার্যকরের ঘটনা বেশ বিরল। ১৯৯৫ সাল থেকে এখন পর্যন্ত দেশটিতে তিনজনের মৃত্যুদ- কার্যকর করা হয়েছে। এদিকে মেমনের মৃত্যুদ- কার্যকর নিয়ে যে আলোচনা-সমালোচনা এবং শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত যে অনিশ্চয়তা কাজ করছিল, তা নজিরবিহীন। ফাঁসি স্থগিত করতে সর্বশেষ গত বুধবার মধ্যরাতে সুপ্রিম কোর্টে জরুরি আবেদন করে আসামিপক্ষ। ইয়াকুবের শেষ মুহূর্তের আবেদন নিয়ে শুনানির জন্য নজিরবিহীনভাবে গভীর রাতে সুপ্রিম কোর্ট খোলা হয়। রাত আড়াইটার দিকে শুরু হয় এক অভূতপূর্ব শুনানি। এতে ইয়াকুবের আইনজীবীরা বলেন, আইন অনুসারে প্রাণভিক্ষার আবেদন নাকচ হওয়ার ১৪ দিনের মধ্যে আসামির ফাঁসি কার্যকর করা যায় না। অন্যদিকে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা বলেন, ইয়াকুব তার দ- চ্যালেঞ্জের যথেষ্ট সুযোগ পেয়েছেন। রাতভর উভয়পক্ষের তর্কবিতর্কের পর সর্বোচ্চ আদালত শুনানি শেষে মেমনের আবেদন খারিজ করে দেন। বহু বিতর্কের পর অবশেষ গতকাল মেমনের জন্মদিনেই তার মৃত্যুদ- কার্যকর করা হয়।
প্রসঙ্গত, তদন্তে প্রমাণিত হয় যে, মুম্বাই বিস্ফোরণের পুরো পরিকল্পনাই করেছিল মেমন পরিবার। ঘটনার আগে পরিবারের অধিকাংশই দেশ ছেড়ে চলে যায়। পরবর্তী সময়ে ইয়াকুব আত্মসমর্পণ করে।
মুম্বাইয়ের সন্ত্রাসবিরোধী টাডা আদালত ইয়াকুবকে ফাঁসির নির্দেশ দিয়েছিলেন। প্রথমে বোম্বে হাইকোর্ট ও পরে সুপ্রিম কোর্ট সেই আদেশ বহাল রাখেন। ইয়াকুবের পক্ষে এরপর রায় পর্যালোচনার আবেদন জানানো হয়। সেই আবেদনও খারিজ হওয়ার পর পুনর্বিবেচনার আবেদন দাখিল করা হয়। গত মঙ্গলবার সেই শুনানিতে দুই বিচারপতির মধ্যে মতের অমিল দেখা দেয়। বিচারপতি কুরিয়েন যোসেফ ‘পদ্ধতিগত ত্রুটি’ উল্লেখ করে বলেন, ত্রুটি সারিয়ে বিচার চূড়ান্ত করা হোক। সে অনুযায়ী, গত বুধবার তিন বিচারপতির বেঞ্চ দীর্ঘ শুনানি শেষে জানান, ফাঁসির আদেশ বহাল রাখা নিয়ে পদ্ধতিগত কোনো ত্রুটি ছিল না। বিচারপতিরা দ-াদেশ স্থগিত রাখার আবেদনও খারিজ করেন।
ইয়াকুবের আইনজীবীর বক্তব্য ছিল, তিন মাস সময় থাকলেও জেল কর্তৃপক্ষ একেবারে শেষ মুহূর্তে তা জানিয়েছে। তা ছাড়া পুনর্বিবেচনার আবেদন ফয়সালা হওয়ার আগেই ফাঁসির আদেশ কার্যকর করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সেই আবেদনের ফয়সালা ত্রুটিযুক্ত। অতএব ফাঁসি স্থগিত রাখা হোক। পাশাপাশি ইয়াকুবের পক্ষ থেকে মহারাষ্ট্রের রাজ্যপাল ও দেশের রাষ্ট্রপতির কাছে নতুন করে প্রাণভিক্ষার আবেদন জানানো হয়। রাজ্যপালের পর রাষ্ট্রপতি তা নাকচ করেন।
নানা তর্ক-বিতর্ক ও নাটকীয়তার পর শেষমেশ জন্মদিনেই ফাঁসিতে ঝুলতে হলো ইয়াকুবকে। গতকাল ইয়াকুবের ৫৩ বছর পূর্ণ হয়। জন্মদিন উপলক্ষে বুধবার মধ্যরাতে নাগপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে ইয়াকুবের জন্য কেক পাঠিয়েছিল পরিবার। কিন্তু ইয়াকুব মেমনের প্রাণভিক্ষার প্রশ্নে বেশ কয়েক দিন ধরে ভারতে যে তুমুল বিতর্ক চলছে, তা অনেকটাই ছিল নজিরবিহীন।
দেশের কয়েকশ বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী, আইন বিশেষজ্ঞ এবং সিপিএম-এনসিপি-বিজেপিসহ বিভিন্ন দলের এমপিরা সরাসরি রাষ্ট্রপতির কাছে চিঠি লিখে বলেছেন, তার ফাঁসির সাজা মওকুফ করে যাবজ্জীবন কারাদ- দেওয়া যেতে পারে।