সড়কে থামছে না মৃত্যুর মিছিল। প্রতিদিন ঝরছে তাজা প্রাণ। ঈদের পর সড়ক দুর্ঘটনা আশঙ্কাজনকহারে বেড়েছে। ঈদের ছুটি শুরু থেকে গতকাল পর্যন্ত পৃথক ঘটনায় ১১৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। গতকালও দেশের বিভিন্ন স্থানে মারা গেছেন ২৪ জন। এর মধ্যে গাজীপুর ৫, মাদারীপুরের কালকিনিতে ৮ এবং টাঙ্গাইলে মারা যান ৩ জন। রাজধানীতে দুর্ঘটনায় মারা গেছেন ৩ জন। বৃহস্পতিবার পৃথক ঘটনায় মারা যান ৩১ জন। এর আগের দিন মৃত্যু হয় ১০ জনের। এছাড়া ঈদের আগে পরে চার দিনে অন্তত ৫৩ জনের মৃত্যু হয়।
স্টাফ রিপোর্টার, গাজীপুর থেকে জানান, গাজীপুরে ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কে লেগুনা-কাভার্ডভ্যান সংঘর্ষে লেগুনার চালকসহ ৪ জন নিহত হয়েছেন। এ ঘটনায় আহত হয়েছেন আরও ১২ জন। আহত ৭ জনকে গুরুতর অবস্থায় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। নিহত চারজনের পরিচয় জানা গেছে। তারা হলেন- নগরের ইটাহাটা এলাকায় বসবাসরত শেরপুরের জিনাইগাতি থানার কানদুলি গ্রামের বাসিন্দা লেগুনাচালক সাইদুর (২৫) ও যাত্রী পটুয়াখালী জেলার গলচিপা থানার উত্তর চরকাজর গ্রামের বাসিন্দা কোনাবাড়ীর কেয়া কসমেটিকসের কর্মচারী সোহেল মিয়া (২৮), নগরের ভোগড়ায় বসবাসরত নওগাঁর বাসিন্দা তমির শেখের স্ত্রী মনিরা বেগম (২৫), মৌলভীবাজারের বড়লেখা থানার খোলাগাঁও গ্রামের সেলিনা বেগম (২৩)। নিহতদের বাকি একজনের পরিচয় তাৎক্ষণিকভাবে জানা যায়নি। দুর্ঘটনার পর প্রায় এক ঘণ্টা ওই মহাসড়কে যানবাহন চলাচলে বিঘ্ন ঘটে।
হাইওয়ে ফাঁড়ি পুলিশের ইনচার্জ এসআই বাহার আলম ক্রাইম রিপোর্টার ২৪.কমকে জানান, শুক্রবার সকাল সাড়ে ৭টায় গাজীপুরের নাওজোড় এলাকায় কোনাবাড়ীগামী যাত্রীবাহী লেগুনা ও বিপরীত দিকের টাঙ্গাইল থেকে আসা কাভার্ডভ্যানের সংঘর্ষ হয়। এতে লেগুনাটি সড়কের পাশে উল্টে ঘটনাস্থলেই তিনজন মারা যান। আহত হন ১৪ জন। ঘটনার খবর পেয়ে দ্রুত হাইওয়ে পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিসের উদ্ধার কর্মীরা ঘটনাস্থলে পৌঁছে। আহতদের উদ্ধার করে গাজীপুর শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হলে আরও একজনের মৃত্যু হয়। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় দুপুরে সেলিনা নামের আরও একজন মারা যান। নিহত সেলিনার প্রতিবেশী জুলেখা জানান, সেলিনা নতুন চাকরিতে যোগ দিতে শুক্রবারই তার স্বামী ফখরুলের সঙ্গে মৌলভীবাজার থেকে গাজীপুরের কোনাবাড়ীতে যাচ্ছিলেন। তার স্বামী ফখরুলও গুরুতর জখম হয়েছেন। আহতদের মাঝে গুরুতর অবস্থায় ৮ জনকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। তারা হলেন- তমির উদ্দিন (২৮), মামুন (২৫), কুদ্দুস (২৮), ফখরুল (৩৫), এনামুল (৩৫), পমির (২৮) ও অজ্ঞাত ২ জন নারী। দুর্ঘটনার পর লেগুনাটি সড়কের পাশে পড়ে যায়। দুর্ঘটনায় কবলিত যানদুটি জব্দ করা হয়।
কালকিনি (মাদারীপুর) প্রতিনিধি ও গৌরনদী (বরিশাল) প্রতিনিধি জানান, মাদারীপুরের কালকিনিতে ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কে পৃথক পৃথক সংঘর্ষে ৬ জন নিহত হয়েছে। আহত হয়েছে কমপক্ষে ২০ জন। শুক্রবার সকালে ও দুপুরে এ দুর্ঘটনা ঘটে।
কালকিনি থানা ও গৌরনদী হাইওয়ে সূত্রে জানায়, শুক্রবার দুপুর ১টার দিকে বরিশাল-ঢাকা মহাসড়কের কালকিনি উপজেলার পাথুরিয়া পাড় এলাকায় একটি যাত্রীবাহী লোকাল বাস ও একটি যাত্রীবাহী মাইক্রোবাসের মধ্যে মুখোমুখি সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এতে ঘটনাস্থলেই ৫ জন নিহত ও অন্তত ২০ জন আহত হন।
তাৎক্ষণিকভাবে হতাহতদের নাম-পরিচয় পাওয়া যায়নি। কালকিনি থানার অফিসার ইনচার্জ কৃপাসিন্দু বালা বলেন- ‘নিহতদের মুখমণ্ডল বিকৃত হয়ে যাওয়ায় এখনও কাউকে শনাক্ত করা যায়নি। পুলিশ নিহতদের লাশ উদ্ধার করে মাদারীপুর হাসপাতালের মর্গে পাঠিয়েছে। আর আহতদের বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, মাদারীপুর ও ফরিদপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পাঠিয়েছে।
অপরদিকে সকাল সাড়ে ১০টার দিকে একই মহাসড়কের বরিশালের গৌরনদী উপজেলার সাউদের খালপাড় নামক স্থানে একটি অজ্ঞাতনামা যানের চাকায় পিষ্ট হয়ে নাসির হাওলাদার (৩৫) নামে এক মোটরসাইকেল আরোহী নিহত হয়েছেন। নিহতের বাড়ি বরিশালের উজিরপুর উপজেলার ওটরা গ্রামে। তিনি ওই গ্রামের মৃত আক্কেল আলী হাওলাদারের পুত্র। গৌরনদী হাইওয়ে থানার ওসি মো. মাহাবুবুর রহমান চৌধুরী ঘটনার সত্যতা নিশ্চত করেন।
বিশ্বনাথ (সিলেট) প্রতিনিধি জানান, সিলেটের বিশ্বনাথে যাত্রীবাহী বাসের ধাক্কায় এক শিশুর মৃত্যু হয়েছে। গতকাল বেলা পৌনে ২টায় উপজেলার বিশ্বনাথ-জগন্নাথপুর সড়কের কালীগঞ্জ বাজার নামক স্থানে এ ঘটনা ঘটে। নিহত শিশুর নাম মনিরুল ইসলাম (৬)। সে নেত্রকোনা জেলার বাসিন্দা এবং তার পিতার নাম কাশেম মিয়া। এ সময় স্থানীয় জনতা বাস ও গাড়ির চালককে আটক করে পুলিশে সোপর্দ করেন।
বিশ্বনাথ থানার ওসি রফিকুল হোসেন সড়ক দুর্ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে বলেন, গাড়ি ও চালককে জনতা আটক করে পুলিশে সোর্পদ করেছেন।
নীলফামারী প্রতিনিধি জানান, অপরদিকে জমি চাষ শেষে উঁচু রাস্তায় ওঠার সময় ট্রাক্টর উল্টে আউয়ুব আলী (২৭) নামের এক ট্রাক্টরচালক নিহত হয়েছেন। ঘটনাটি ঘটেছে, গতকাল সকালে নীলফামারী কলেজ স্টেশন সংলগ্ন হাড়োয়া গ্রামে। আউয়ুব আলী লালমনিরহাট জেলার হাতীবান্ধা উপজেলার জোবেদ আলীর ছেলে বলে জানা গেছে। নীলফামারী সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা শাহজাহান পাশা জানান, লাশ উদ্ধর করা হয়েছে।
ঝিনাইগাতী (শেরপুর) প্রতিনিধি জানান, শুক্রবার ঝিনাইগাতী-শেরপুর রোডে আহমদ নগর নামক স্থানে বাসের চাপায় আবুল কাসেম (৩৫) নামে এক ব্যক্তি নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন আরও চারজন। আহতরা হলেন- মাটিয়াপাড়া গ্রামের ইয়াসিন (১২), সুরুজ আলী (৫৫), মমতাজ বেগম (২৮), আবদুুল খালেক (২০)। নিহত আবুল কাসেম ঝিনাইগাতী উপজেলা সদরের লুতফর রহমানের ছেলে।
পুলিশ জানায়, সকাল ১০টার দিকে এসআই ক্ল্যাসিক ট্রাভেল নামে একটি বাস ঝিনাইগাতী থেকে ঢাকার উদ্দেশে রওনা হলে আহমদনগর নামক স্থানে বাসটি অটোরিকশাকে চাপা দিয়ে পালিয়ে যায়। পরে নিহত আবুল কাসেমকে ঝিনাইগাতী হাসপাতালে আনা হলে ডা. তাকে মৃত ঘোষণা করেন। আহতরা প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে চলে যান। থানায় মামলা দায়েরের প্রক্রিয়াধীন রয়েছে বলে এসআই ইউনুস জানান।
কাউনিয়া (রংপুর) প্রতিনিধি জানান, কাউনিয়ায় নৈশ কোচ খাদে পড়ে প্রায় ৩৫ জন আহত হয়েছেন।
গত বৃহস্পতিবার রাত ১২টার দিকে রংপুর-কুড়িগ্রাম মহাসড়কের বেইলীব্রীজ এলাকায় পৌছলে এ দুর্ঘটনা ঘটে। এ সময় প্রায় ৩৫জন আহত হন।
স্টাফ রিপোর্টার, বরিশাল থেকে জানান, কালকিনির পাথুরিয়া পাড় এলাকায় দুর্ঘটনায় আহতদের মধ্যে ২ জনকে বরিশাল শেবাচিম হাসপাতালে আনার পথেই মৃত্যু হয়েছে। গতকাল সন্ধ্যায় স্বজনরা তাদের মৃতদেহ নিয়ে যান। মৃত দু’জন হলেন বরিশাল নগরীর খান সড়কের শাহরিয়ার শুভ (৩০) এবং আবদুর রব (৬৫)। এ ঘটনায় আহত অবস্থায় ৮ জনকে শেবাচিম হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। কর্তৃব্যরত চিকিৎসক ডা. এসএম ইফতেখার উদ্দিন জানান, ভর্তি হওয়া রোগীর মধ্যে ৩ জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক।
স্টাফ রিপোর্টার, টাঙ্গাইল থেকে জানান, টাঙ্গাইলে পৃথক দুটি সড়ক দুর্ঘটনায় তিনজন নিহত হয়েছেন। প্রথম দুর্ঘটনাটি ঘটে বৃহস্পতিবার গভীর রাতে। গাইবান্ধা থেকে আগত ঢাকাগামী তিতাস এন্টারপ্রাইজের একটি বাস মির্জাপুর উপজেলার সোহাগপাড়ায় এলে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে বাসটি খাদে পড়ে যায়। এতে ১৭ জন যাত্রী আহত হন। আহতদের মির্জাপুর কুমুদিনী হাসপাতালে ভর্তি করা হলে গতকাল দুজনের মৃত্যু হয়। এরা হলেন-গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জের শাহানুল বেগম (৩০) ও নীলফামারীর কিশোরীগঞ্জের রোকনুজ্জমান (২৫)। অপর দুর্ঘটনাটি ঘটে সদর উপজেলার দরুন এলাকায়। ওই এলাকার সাইকেল আরোহী সেলিম মিয়াকে (২৬) একটি বাস চাপা দিলে তিনি ঘটনাস্থলেই মারা যান।
ঠাকুরগাঁও প্রতিনিধি জানান, ঠাকুরগাঁও জেলার পীরগঞ্জে সড়ক দুর্ঘটনায় মনির উদ্দিন (৬০) নামে এক বৃদ্ধের মৃত্যু হয়েছে। গতকাল সন্ধ্যা ৭টায় পীরগঞ্জ-রানীশংকৈল সড়কের গনিরহাট নামক স্থানে রাস্তা পারাপারের সময় দ্রুতগামী মোটরসাইকেলের ধাক্কায় এ দুর্ঘটনা ঘটে। মনির উদ্দিন ওই উপজেলার ছিদ্রগরগাঁও গ্রামের মৃত আব্দুল্লাহ’র ছেলে।
রাজধানীতে বিভিন্নস্থানে পৃথক সড়ক দুর্ঘটনায় পুলিশ সদস্যসহ ৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। তারা হচ্ছেন, মুজিবুর রহমান (৫৩), নাসরিন আক্তার (১৯) ও পুলিশ সদস্য সোহেল রানা (৩০)। গতকাল লাশগুলো উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মর্গে পাঠিয়েছে পুলিশ। গতকাল দুপুর আড়াইটার দিকে মালিবাগ থেকে মোটরসাইকেল যোগে ফার্মগেটে যাচ্ছিলেন পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) কনস্টেবল সোহেল রানা। কাওরান বাজারের বিআরবি ক্যাবলস’র এমআরএস ভবনের সামনে দুর্ঘটনার শিকার হন তিনি। এ সময় পিছন থেকে মিরপুরগামী একটি যাত্রীবাহী বাস তাকে ধাক্কা দিলে গুরুতর আহত হন সোহেল রানা। আশঙ্কাজনক অবস্থায় তাকে উদ্ধার করে ঢামেক হাসপাতালে নিয়ে গেলে সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত বলে ঘোষণা করেন তাকে। তেজগাঁও থানার ওসি মাজহারুল ইসলাম জানান, দুর্ঘটনার পরে নৌ-বাহিনীর একটি গাড়িতে করে সোহেলকে ঢামেক হাসপাতালে নেয়া হয়। খবর পেয়ে পুলিশ বাসটি জব্দ করে এবং চালককে আটক করে।
ভোর পৌনে ৫টার দিকে কুড়িল ফ্লাইওভারে বাসের চাকায় পৃষ্ট হয়ে ঘটনাস্থলেই মারা যান এক তরুণী। তার নাম নাসরিন। খিলক্ষেত থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নজরুল ইসলাম জানান, চালক নিয়ন্ত্রণ হারালে বাস থেকে পড়ে যান নাসরিন। ওই বাসের পেছনের চাকায় পৃষ্ট হয়ে ঘটনাস্থলেই মারা যান তিনি। এ ঘটনায় আরও দুইজন আহত হয়েছেন। তাদের কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। এ ঘটনায় বাসটি আটক করা হলেও দুর্ঘটনার পর চালক পালিয়ে যায়।
নাসরিনের গ্রামের বাড়ি বরিশালের হিজলায়। টঙ্গিতে একটি গার্মেন্টে কাজ করতেন তিনি। ঈদের ছুটি শেষে গ্রামের বাড়ি থেকে ছোট ভাইকে নিয়ে লঞ্চে সদর ঘাটে আসেন তিনি। সেখান থেকে সুপ্রভাত পরিবহনের একটি বাসযোগে সদরঘাট থেকে টঙ্গি যাচ্ছিলেন নাসরিন। পথে কুড়িল ফ্লাইওভার থেকে নিচে নামার সময় দুর্ঘটনা ঘটে।
সকাল সাড়ে ১১টার দিকে কলাপট্টি থেকে রাস্তা পার হওয়ার সময় বাসের ধাক্কায় এক ব্যক্তি গুরুতর আহত হন। তার নাম মজিবুর রহমান। পথচারীরা তাকে উদ্ধার করে ঢামেক হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখানে ১২টা ১০ মিনিটে চিকিৎসক মৃত বলে ঘোষণা করেন তাকে। কাফরুল থানার এসআই মনিরুজ্জামান জানান, সকাল ৮টার দিকে পশ্চিম শেওড়াপাড়ায় রাস্তা পার হওয়ার সময় দ্রুতগতিতে আসা একটি বাসের ধাক্কায় আহত হন আরিফুল ইসলাম সেলিম। আশঙ্কাজনক অবস্থায় তাকে উদ্ধার করে ঢামেক হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে কর্তব্যরতক চিকিৎসক মৃত বলে ঘোষণা করেন তাকে। নিহত আরিফুল ইসলাম সেলিম পশ্চিম শেওড়াপাড়ায় থাকতেন। তিনি টাঙ্গাইল জেলার বাসিন্দা। তার পিতার নাম সামসুল ইসলাম। সেলিম একটি প্রাইভেট কোম্পানিতে কাজ করতেন বলে জানা গেছে।