ক্যালেন্ডারের পাতা ঘুরে আজ আমাদের সমগ্র মুসলিম মিল্লাতের মাঝে ফিরে এসেছে পবিত্র সিয়াম সাধনার মাস ১৪৩৬ হিজরির প্রথম রমজানুল করিম। প্রথমেই মোনাজাত করি আল্লাহ্পাকের আছে তিনি যেন আমাদিগকে পবিত্র রমজান মাসের সম্পূর্ণ রোজা রাখার তৌফিক দান করেন। রোজাকে আরবি ভাষায় সিয়াম বা সাওম, আর ফার্সিতে রোজা বলা হয়। সাওম অর্থ বিরত থাকা। আর শরীয়তের পরিভাষায় ফরজ রোজা রাখার নিয়তে সুব্হে সাদিক থেকে সুর্যাস্ত পর্যন্ত জিহ্বা অর্থাৎ কোন কিছু পানাহার এবং (স্ত্রী সহবাস) লজ্জাস্থানকে নিয়ন্ত্রণ রাখার নাম সাওম বা রোজা। মহান আল্লাহ্পাক রাব্বুল আলামীন মুমিন বান্দাদিগকে তাঁর কাছে টেনে নেয়ার জন্য এই পবিত্র মাসের রোজাকে তিন ভাগে বিভক্ত করেছেন। প্রথম দশদিন রহমতের, দ্বিতীয় দশদিন মাগফিরাতের এবং তৃতীয় দশদিন দোযখ থেকে মুক্তির জন্য। আল্লাহ পাকের নির্দেশে আকাশের মেঘমালা বছরের প্রথমে যে বারিধারা বর্ষণ করে থাকে, তাতে মৃত জমিন যেমন সুজলা-সফুলা, শস্য-শ্যামল হয়ে পৃথিবীকে নব শক্তিতে বলিয়ান করে থাকে। অনুরূপভাবে মাহে রমজানের রোজা মুমিন বান্দাদের আত্মাকে নব শক্তিতে বলিয়ান করে। ইসলামের প্রথম স্তম্ভ নামাজ যেমন মুমিনদেরকে শিক্ষা দেয় শৃঙ্খলা ও নিয়মানুবর্তি। তেমনি মাহে রমজানের রোজা শিক্ষা দেয়, তাক্ওয়া, সহিঞ্চুতা ও সংযম। মহান আল্লাহ্পাক সমস্ত মানবজাতিকে সম্বোধন করে পবিত্র কোরআনে ঘোষণা করেন যে, হে মুমিনগণ! তোমাদের জন্য সিয়ামের বিধান দেয়া হলো, যেমন বিধান তোমাদের পূর্ববর্তীগণকে দেয়া হয়েছিল, যাতে তোমরা মুত্তাকী হতে পারো (সূরায়ে বাকারা-১৮৩)
আল্লাহ্পাক আরও ঘোষণা করেন যে, রমজান মাস, ইহাতে মানুষের দিশারী এবং সৎপথের স্পষ্ট নিদর্শন ও সত্যাসত্যের পার্থক্যকারীরূপে আল কোরআন অবতীর্ণ হয়েছে। সুতরাং তোমাদের মধ্যে যারা এই মাস পাবে তারা যেন এই মাসে সিয়াম পালন করে। এবং কেউ পীড়িত থাকলে কিংবা সফরে থাকলে অন্য সময় এই সংখ্যা পূরণ করবে। আল্লাহ্ তোমাদের জন্য যা সহজ তা চান এবং যা তোমাদের জন্য কষ্টকর তা চান না, এজন্য তোমরা সংখ্যাপূর্ণ করবে এবং তোমাদেরকে সৎপথে পরিচালিত করার কারণে তোমরা আল্লাহ্র মহিমা ঘোষণা করবে এবং যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে পারো (সূরায়ে বাকারা-১৮৫)
প্রতিটি ইবাদত বিশুদ্ধ হওয়ার জন্য নিয়ত করা জরুরি। রোজা বিশুদ্ধ হওয়ার জন্য ও নিয়ত অন্যতম শর্ত। নিয়ত ব্যতীত রোজা শুদ্ধ হবে না। নিয়ত ব্যতীত পুরোদিন কোন কিছু পানাহার থেকে বিরত থাকাকে রোজা বলা হবে না। তবে হ্যাঁ, নিয়তমুখে উচ্চারণ করা জরুরি নয় বরং সেহ্রির সময় উঠা এবং সেহ্রি খাওয়াটাও নিয়তের মধ্যে গণ্য হইবে। তবে মুখের দ্বারা নিয়ত প্রকাশ করা উত্তম এবং রমজান মাসের প্রত্যেক রোজাতে নিয়ত করা একান্ত জরুরি। একদিন নিয়ত করে নেয়া সমস্ত রোজার জন্য যথেষ্ট নহে।
রোজার নিয়ত: নাওয়াইতু আন আছুমা গাদাম মিন শাহ্রী, রামাজানাল মোবারাকি, ফারদাল্লাকা ইয়া আল্লাহু, ফাতাকাব্বাল মিন্নী, ইন্নাকা আনতাছ সামিউল আলীম। রোজা নিয়ত আরবিতে না পারলেও বাংলায় বলতে পারবেন যে আমি আগামীকাল আপনার ফরজকৃত রমজান শরীফের ফরজ রোজা রাখার নিয়ত করলাম। হে আল্লাহ্ আমার রোজা কবুল করুন। নিশ্চয় আপনি সর্বশ্রোতা ও সর্বজ্ঞানী। উল্লেখ্য, পূর্বের রাতে নিয়ত করলে উপরোক্ত নিয়তই করবে। যদি রোজার দিন সকালে সুব্হে সাদিকের পর নিয়ত করা হয় তাহলে ‘গাদাম’ এর স্থলে ‘আল ইয়াওমা’ অর্থাৎ আজকের বলবেন।
জ্জো ফরজ হওয়ার সংক্ষিপ্ত শর্তসমূহ: যার মাঝে নিম্নোক্ত শর্তগুলো পাওয়া যাবে, তার উপর রমজান মাসের রোযা যথা সময়ে আদায় করা এবং যথা সময়ে আদায় করতে না পারলে কাজা আদায় করা ফরজ।
* বালিগ হওয়া, সুতরাং নাবালিগের উপর রোজা ফরজ নয়। * মুসলমান হওয়া, সুতরাং কাফিরের উপর রোজা ফরজ নয়। * জ্ঞান সম্পন্ন হওয়া, সুতরাং পাগলের উপর রোজা ফরজ নয়। * দারুল ইসলামের অধিবাসী হওয়া অথবা দারুল হারবে থাকলে ও রোজা ফরজ হওয়ার ব্যাপারে জ্ঞাত থাকা।
রোজা রাখা কার উপর ফরজ: * মুক্বীমের উপর রোজা রাখা ফরজ, সুতরাং মুসাফিরের জন্য রোজা রাখা ফরজ নয়। * সুস্থ ব্যক্তির জন্য রোজা রাখা ফরজ, সুতরাং অসুস্থ ব্যক্তির জন্য রোযা রাখা ফরজ নয়। * যে সকল মহিলা হায়েজ ও নেফাস হতে মুক্ত তাহাদের জন্য রোজা রাখা ফরজ, সুতরাং হায়েজ ও নেফাস সম্পন্না মহিলাদের জন্য রোজা রাখা ফরজ নয়।
যে সকল কারণে রোজা ভঙ্গ হয়ে যায়; তার সংক্ষিপ্ত বিবরণ: রোজা রেখে ইচ্ছাকৃতভাবে খানাপিনা ও স্ত্রী সম্ভোগ করার মাধ্যমে রোজা ভঙ্গ হয়ে যায়। আর এতে কাযা ও কাফ্ফারা উভয় ওয়াজিব। অনিচ্ছাকৃতভাবে অযু-গোসলে পানি বা অন্য কোন খাদ্যদ্রব্য গলায় চলে গেলে রোজা ভঙ্গ হয়ে যায়। এতে শুধু কাযা ওয়াজিব। নাকের ছিদ্রপথে কোন কিছু পেটে গেলে, দাঁতের মধ্যকার কোন খাদ্য বুট পরিমাণ পেটে গেলে রোজা ভঙ্গ হয়ে যায়; এতে শুধু কাযা ওয়াজিব।
যে সব কারণে রোজা শুরু করার পর ভেঙে ফেলার অনুমতি রয়েছে:
* যদি এমন পিপাসা বা ক্ষুধা লাগে, যাতে প্রাণনাশের আশঙ্কা দেখা দেয়। * যদি এমন কোন রোগ দেখা দেয় যে, ওষুধপত্র গ্রহণ না করলে জীবনের আশা ত্যাগ করতে হয় * গর্ববতী মহিলাদের যদি এমন অবস্থা হয় যে, নিজের অথবা সন্তানের প্রাণনাশের আশঙ্কা হয় * বেহুঁশ বা পাগল হয়ে গেলে। এসব অবস্থায় যে রোজা তরক করা হবে পরে তা কাযা আদায় করতে হবে।