দীর্ঘ বিনিয়োগ মন্দায় ব্যাংকিং খাতে উদ্বৃত্ত তারল্য ও অলস টাকার পাহাড় সৃষ্টি হয়েছে। তারল্যের চাপ ও তহবিল ব্যয় কমাতে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ রেপোতে একদিনের জন্য অর্থ খাটাচ্ছে ব্যাংকগুলো। ফলে রিজার্ভ রোপোর দৈনিক লেনদেনে বড় স্ফীতি ঘটছে। এক মাস আগে রিজার্ভ রেপোতে যেখানে দৈনিক ১০০ থেকে ৫০০ কোটি টাকার মধ্যে লেনদেন হত, এখন তা ১০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। অন্যদিকে, কম লাভ হবে জেনেও আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারেও (কলমানি মার্কেট) বেশির ভাগ ব্যাংকের অর্থ খাটানোর প্রবণতা বেড়েছে। এতে কলমানি সুদও পড়ে যাচ্ছে। বর্তমানে ব্যাংকিং খাতে সোয়া লাখ কোটি টাকার বেশি অতিরিক্ত তারল্য রয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এবার সরকারি ও বেসরকারি উভয় খাতেই ব্যাংক ঋণের চাহিদা কমে যাওয়ায় এ খাতে প্রতিদিনই অতিরিক্ত তারল্য জমা হচ্ছে। যা নিয়ে যথারীতি বিপাকে পড়তে হচ্ছে ব্যাংকগুলোকে। ফলে বেশি সুদের আমানতের অর্থ বাধ্য হয়েই তারা আন্তঃব্যাংক কলমানির পাশাপাশি বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ রেপোতে রাখছে। ইচ্ছা না থাকলেও বাংলাদেশ ব্যাংক সেগুলো রাখতে বাধ্য হচ্ছে। নইলে ব্যাংকের এসব অলস অর্থ ঝুঁকিপূর্ণ খাতে চলে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এদিকে, সরকারের ব্যাংক ঋণের চাহিদা কমে যাওয়া ও ব্যাংকগুলোর রিজার্ভ রেপোতে অর্থ খাটানো বাড়ায় বাংলাদেশ ব্যাংকের আয়ে বড় ধরনের ধাক্কা লাগতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। রেপো (পুনঃক্রয় চুক্তি) ও রিভার্স রেপো (বিপরীত পুনঃক্রয় চুক্তি) বাংলাদেশ ব্যাংকের মুদ্রানীতি বাস্তবায়নের অন্যতম হাতিয়ার। তারল্য ব্যবস্থাপনা সহজ করার প্রক্রিয়া হিসেবে ট্রেজারি বিল, ট্রেজারি বন্ড ও বাংলাদেশ ব্যাংক বিল জামানত হিসেবে রেখে ব্যাংকগুলোকে স্বল্প মেয়াদি তহবিল দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এ প্রক্রিয়াকে রেপো বলা হয়। বর্তমানে রেপোর সুদহার সোয়া ৭%। অন্যদিকে বাজারে তারল্য পরিস্থিতিকে প্রত্যাশিত মাত্রায় রাখতে ব্যাংকগুলো থেকে অতিরিক্ত অর্থ শুষে নেয়ার প্রক্রিয়াকে রিভার্স রেপো বলা হয়। বর্তমানে রিজার্ভ রেপোর সুদহার সোয়া ৫%। সাধারণত মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে এই দুটি হাতিয়ার ব্যবহার করে বাংলাদেশ ব্যাংক। যোগাযোগ করা হলে বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলেন, ব্যাংকের কাছে প্রচুর উদ্বৃত্ত তারল্য জমায় তারা রিজার্ভ রেপো করছে। তিনি বলেন, সরকারি ও বেসরকারি খাতে ঋণ চাহিদা কম থাকাই এ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। অপর এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেন, প্রতি বছরই সরকার ব্যাংক থেকে বড় অঙ্কের ঋণ নেয়ার পরিকল্পনা করে। সে পরিকল্পনা অনুযায়ী ব্যাংকগুলোও সরকারকে ঋণ দিতে বাধ্য থাকে। কিন্তু এবার সঞ্চয়পত্র বিক্রি থেকে অস্বাভাবিক ঋণ পাওয়ায় সরকারের ব্যাংকঋণের চাহিদা কমতে কমতে শূন্যে নেমে এসেছে। ফলে ব্যাংকগুলো সরকারি ট্রেজারি বিল ও বন্ডে টাকা খাটানোর যে পরিকল্পনা করেছিল সেটি সম্ভব হয়নি। অন্যদিকে বিনিয়োগ মন্দার কারণে দীঘদিন ধরেই বেসরকারি খাতে ঋণের চাহিদা কম হচ্ছে। এতে ব্যাংকগুলো অলস টাকা বৃদ্ধির আশঙ্কায় অধিক হারে রিজার্ভ রেপো করছে। চলতি অর্থবছরে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সরকারের ঋণ নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে ৩১,২২১ কোটি টাকা। অথচ অর্থবছরের ১১ মাস অতিক্রম হলেও এই খাত থেকে সরকারকে কোন ঋণ করতে হয়নি। ফলে সরকারের নিট ব্যাংকঋণ এখন ঋণাত্মক ধারায় নেমে এসেছে। এছাড়া বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে সরকারের ধার করা ঋণ চিত্রও প্রথমবারের মতো ঋণাত্মক ধারায় নেমে এসেছে। চলতি অর্থবছরের মে পর্যন্ত সরকারের নিট ব্যাংক ঋণ ঋণাত্মক রয়েছে (-) ১০,৯৭৬ কোটি টাকা। এর মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে ঋণাত্মক ৮,৭৯৫ কোটি টাকা এবং বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর কাছে ঋণাত্মক ২,১৮০ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদনে দেখা যায়, মে মাসের শুরু থেকেই রিজার্ভ রেপোতে ব্যাংকগুলোর অর্থ খাটানোর প্রবণতা বাড়তে থাকে। জুন মাসের শুরুতে সেটি আরও জোরালো হয়েছে। মে মাসে দেড় হাজার কোটি টাকায় শুরু হওয়া লেনদেন ৩১শে মে ৮,৮০৯ কোটি টাকায় গিয়ে ঠেকে। ১লা জুন তা সর্বোচ্চ ১০,৪১৪ কোটি টাকায় পৌঁছায়। ২রা জুনও ১০ হাজার কোটি টাকার ওপরে লেনদেন হয়েছে। অথচ এপ্রিল মাসেও রিজার্ভ রেপোর দৈনিক লেনদেন ১০০ কোটি থেকে ৮০০ কোটি টাকার মধ্যে সীমিত ছিল। অন্যদিকে সামপ্রতিক সময়ে আন্তঃব্যাংক কলমানি মার্কেটের সুদের হার প্রায় ১% কমেছে। বর্তমানে তা ৭ শতাংশের নিচে অবস্থান করছে। গত ৩১শে মে ব্যাংক টু ব্যাংক কলমানি সুদের সর্বোচ্চ ৬.২৫%। তবে ব্যাংক টু নন ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের এই হার ছিল সর্বোচ্চ ৬.৭৫%। অথচ মে মাসের শুরুতে ব্যাংক টু ব্যাংকের কলমানি সুদের হার ছিল সাড়ে ৭%। আর ব্যাংক টু আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে এই হার ছিল ৮%।