মন্ত্রিসভা গতকাল সোমবার সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য এক বিশেষ সুবিধা আইনের খসড়া অনুমোদন করেছে। প্রস্তাবিত আইনটি ‘সরকারি কর্মচারী আইন ২০১৫’ নামে অভিহিত হবে। প্রস্তাবিত খসড়ায় বলা হয়েছে, “ফৌজদারি মামলায় অভিযোগ পত্র আদালতের অনুমোদনের পূর্বে কোন সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীকে গ্রেফতার করতে হলে সরকারের পূর্ব অনুমোদন নিতে হবে।” এই সুবিধা আইন অন্য কোন পেশার লোকদের জন্য প্রযোজ্য নয়। এমনকি সরকারের মন্ত্রী-এমপিদেরকেও কোন ফৌজদারি মামলায় গ্রেফতার করতে হলে কারো অনুমতি নেয়ার প্রয়োজন পড়ে না। আইন বিশেষজ্ঞরা প্রস্তাবিত এই আইনকে সংবিধানের ৭, ২৬ ও ২৭ অনুচ্ছেদের লংঘন হিসেবে অভিহিত করেছেন। তারা বলেছেন, এই আইনটি এমনভাবে করা হয়েছে যাতে মনে হতে পারে “আইন সকলের জন্য সমান নয়।” সরকারি কর্মচারীদের জন্য এক রকম এবং রাজনীতিবিদ ও সাধারণ মানুষের জন্য অন্য রকম কাম্য হতে পারে না। মন্ত্রিসভায় অনুমোদিত আইনটি রাষ্ট্র বনাম এইচআরপিবি (হিউম্যান রাইটস এন্ড পিস ফর বাংলাদেশ) মামলার রায়েরও চেতনার পরিপন্থি। ইতিপূর্বে এ ধরনের একটি বিশেষ সুবিধা আইন হাইকোর্ট বাতিল করে দিয়েছিল।
গতকাল প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিপরিষদের বৈঠকে সরকারি কর্মচারী আইন ২০১৫ এর বিলের খসড়া নীতিগত অনুমোদন হয়। প্রস্তাবিত আইনটি সংবিধানের সমতার নীতির লংঘন বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। প্রসঙ্গত সংবিধানের ২৭ অনুচ্ছেদে উল্লেখ রয়েছে, “সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয়লাভের অধিকারী।” কিন্তু এই আইন সাংবিধানিক বৈষম্য সৃষ্টি করবে। এখানে উল্লেখ্য যে, ফৌজদারি মামলায় সংসদ সদস্যদের গ্রেফতারে আইনি কোন বাধা নেই। সংসদ সদস্যদের গ্রেফতারের পর স্পিকারকে জানানোর বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এ সংক্রান্ত জাতীয় সংসদের কার্যপ্রণালী বিধির ১৭২ বিধিতে বলা হয়েছে, “কোন সদস্য ফৌজদারি অভিযোগে বা অপরাধে গ্রেফতার হইলে কিংবা কোন আদালত কর্তৃক কারাদণ্ডে দণ্ডিত হইলে বা কোন নির্বাহী আদেশক্রমে আটক হইলে ক্ষেত্রমত গ্রেফতারকারী বা দণ্ডদানকারী বা আটককারী কর্তৃপক্ষ বা জজ বা ম্যাজিষ্ট্রেট বা নির্বাহী কর্তৃপক্ষ তৃতীয় তফসিলে প্রদত্ত যথাযথ ফরমে অনুরূপ গ্রেফতার, দণ্ডজ্ঞাবা আটকের কারণ বর্ণনাপূর্বক অবিলম্বে অনুরূপ ঘটনা স্পিকারকে জানাইবেন।” তবে ১৭৪ বিধি অনুযায়ী শুধুমাত্র সংসদের সীমার মধ্যে কাউকে গ্রেফতার করতে হলে স্পিকারের অনুমতি নিতে হয়। সংসদের সীমানার বাইরে মন্ত্রি, এমপিদের গ্রেফতারে আইনি কোন বাধা নেই।
কিন্তু সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের গ্রেফতার করাই যাবে না সরকারের অনুমোদন ছাড়া। সংবিধানের ২৬ অনুচ্ছেদে বলা আছে, “এই সংবিধানের বিধানাবলী লংঘন করে রাষ্ট্র কোন আইন প্রণয়ন করতে পারবে না। ২৬(২) অনুচ্ছেদে উল্লেখ রয়েছে, “রাষ্ট্র এই ভাগের কোন বিধানের সহিত অসামঞ্জস্য কোন আইন প্রণয়ন করিবেন না এবং অনুরূপ কোন আইন প্রণীত হইলে তাহা এই ভাগের কোন বিধানের সহিত যতখানি অসামঞ্জস্যপূর্ণ, ততখানি বাতিল হইয়া যাইবে।”
২০১৩ সালে সরকারি কর্মচারীদের বিশেষ সুবিধা দিতে আরেকটি আইন সংসদে পাস হয়েছিলো। দুর্নীতি দমন কমিশন সংশোধন আইনের ৩২(ক) ধারা অন্তর্ভুক্ত করে বলা হয়, “জজ, ম্যাজিস্ট্রেট বা সরকারি কর্মচারীদের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের ক্ষেত্রে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৯৭ ধারা আবশ্যিকভাবে পালন করতে হবে। প্রসঙ্গত ফৌজদারি কার্যবিধির ১৯৭ ধারায় বলা আছে জজ, ম্যাজিস্ট্রেট বা সরকারি কর্মকর্তা কোনো অভিযোগে অভিযুক্ত হলে সরকারের অনুমোদন ছাড়া কোনো আদালত সেই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ আমলে নিতে পারবেন না। কোন্ আদালতে এই মামলার বিচার হবে, তা সরকার নির্ধারণ করে দেবে। এর ফলে কমিশন সরকারের অনুমোদন ছাড়া সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে কোনো মামলা আমলে নিতে পারছিলো না। সংসদে পাসকৃত এই আইনের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে উচ্চ আদালতে একটি রিট আবেদন দায়ের করা হয়েছিলো। রাষ্ট্র বনাম এইচআরপিবি মামলার রায়ে হাইকোর্ট ওই আইনকে সংবিধান পরিপন্থী বলে ঘোষণা করেছিলো। ওই রায়ে বলা হয়, দেখা গেল, কোনো একটি দুর্নীতির ঘটনায় সরকার প্রধান বা মন্ত্রীদের সঙ্গে সরকারি কর্মচারী জড়িত। এ অবস্থায় সরকার প্রধান কিংবা মন্ত্রীর বিরুদ্ধে মামলা করা যাবে; কিন্তু সরকারি কর্মচারীর বিরুদ্ধে মামলা করতে গেলে অনুমতি লাগবে। সরকার প্রধান কিংবা মন্ত্রী মামলার মুখোমুখি হবেন। এই পরিস্থিতির সমন্বয় কিভাবে ঘটনো হবে তার কোনো দিক-নির্দেশনা সংশোধিত দুদক আইনে নেই। ফলে আইনে এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি করা অযৌক্তিক। রায়ে বলা হয়, কার্যত এটা কোনো আইনই নয়। সংশোধিত এ আইন দেশের সাধারণ মানুষ এবং দুর্নীতিগ্রস্তদের মধ্যে বিভাজন তৈরি করবে। দুর্নীতিবাজদের রক্ষাকবচ হবে। যা অসাংবিধানিক। এমন আইন দেশের বিপুল জনগোষ্ঠীর সঙ্গে বৈষম্যমূলক ছাড়া আর কিছুই নয়। রায়ে আরো বলা হয়, সংবিধান অনুযায়ী একটি বিশেষ শ্রেণীকে বিশেষ সুবিধা দেয়ার সুযোগ নেই। রায়ে সংবিধানের ৭(২) অনুচ্ছেদ তুলে ধরে বলা হয়, সংশোধিত দুদক আইনের ৩২(ক) ধারা অবৈধ ও বাতিলযোগ্য। কারণ সংবিধানের ওই অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘জনগণের অভিপ্রায়ের পরম অভিব্যক্তিরূপে এই সংবিধান প্রজাতন্ত্রের সর্বোচ্চ আইন এবং অন্য কোনো আইন যদি এই সংবিধানের সহিত অসামঞ্জস্যপূর্ণ হয়, তাহা হইলে সেই আইনের যতখানি অসামঞ্জস্যপূর্ণ, ততখানি বাতিল হইবে।’ এছাড়া সংবিধানের ২৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সংশোধিত দুদক আইন অবৈধ ও বাতিলযোগ্য। রায়ে বলা হয়, সংবিধানের ২৭ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী অযৌক্তিক আইন প্রকৃতপক্ষে কোনো আইন হতে পারে না। কারণ আইনের দৃষ্টিতে সব নাগরিক সমান অধিকার পাবে। কিন্তু সরকারি কর্মচারীদের ক্ষেত্রে সংশোধিত আইনে বিশেষ সুবিধা দেয়া হয়েছে। যা সংবিধানের ২৭ অনুচ্ছেদে দেয়া সমতার নীতির লঙ্ঘন। মন্ত্রিসভায় গতকাল পাসকৃত আইনটি হাইকোর্টের উক্ত রায়ের চেতনার পরিপন্থী বলে মনে করেন আইন বিশেষজ্ঞরা।
মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোশাররাফ হোসাইন ভুঁইয়া মন্ত্রিসভার বৈঠক শেষে এক ব্রিফিংয়ে বলেন, গ্রেফতারে অনুমোদনের প্রয়োজন হলেও সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কোনো অপরাধের অভিযোগ তদন্ত কিংবা মামলা দুর্নীতি দমন কমিশনসহ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান করতে পারবে বলে জানান তিনি। এ আইনটিকে ‘যুগান্তকারী’ উল্লেখ করে মোশাররাফ বলেন, অনেক বছর ধরে এ আইনটি নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল। নতুন আইন কার্যকর হলে সেটাই প্রাধান্য পাবে বলে জানান মন্ত্রিপরিষদ সচিব। সরকারি কর্মচারীর সংজ্ঞায় প্রজাতন্ত্রের বিভিন্ন কাজে নিয়োজিত অনেকে থাকলেও এই আইনের আওতায় অনেকে থাকছেন না বলে জানান তিনি। গতানুগতিকভাবে যাদের সরকারি কর্মচারী বলা হয় আমাদের মতো, তারাই এ আইনে কাভার করে,” বলেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব। এ আইন জারি হওয়ার পর এর আওতায় বিভিন্ন বিধিমালা জারি করা হবে জানিয়ে তিনি বলেন, তার আগ পর্যন্ত বিদ্যমান বিধিমালা বহাল থাকবে।