ঢাকার বিহারি ক্যাম্প সরিয়ে নেবে সরকার
বহুল আলোচিত রাজধানীর বিহারি ক্যাম্পগুলো ঢাকার আশপাশের জেলায় সরিয়ে নেয়ার পরিকল্পনা করছে সরকার। ক্যাম্পগুলোতে মানুষের অমানবিক জীবনযাপনকে সহনীয় করে তুলতে ঢাকার বাইরে পুনর্বাসনের উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, গতবছর মিরপুর বিহারি ক্যাম্পে অগ্নিকাণ্ডে কয়েকজনের প্রাণহানির ঘটনার পর থেকেই এ উদ্যোগ নিয়ে সরকার সামনে এগিয়ে যাচ্ছে। এদিকে, সরকারের এ উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছেন ক্যাম্পে বসবাসকারীসহ অবাঙালি মানুষরা। তবে, পুনর্বাসন প্রক্রিয়ায় বিহারি ক্যাম্পের মানুষদের সম্পৃক্ত করে যে কোন সিদ্ধান্ত নেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। একইসঙ্গে তারা এও বলছেন, যেসব জায়গা খালি হবে স্বচ্ছভাবে তা ব্যবহারের ব্যবস্থা করতে হবে। এমন যেন মনে না হয়, এই দামি জায়গাগুলো খালি করার জন্যই তাদের সরানো হচ্ছে।
বর্তমানে রাজধানীর মোহাম্মদপুর ও মিরপুরের কয়েকটি এলাকায় জেনেভা ক্যাম্পসহ অন্য ক্যাম্পগুলোতে বসবাস করছে অবাঙালিরা। এসব ক্যাম্প নানা অপরাধের ঘাঁটি। এছাড়া ঘিঞ্জি, অস্বাস্থ্যকর- নোংরা পরিবেশে মানবেতর জীবনযাপন করতে বাধ্য হচ্ছে তারা। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই এই ক্যাম্পগুলোতে প্রায় দুই প্রজন্ম ধরে বসবাস করছে এই হতভাগ্য মানুষগুলো। তাদের নিয়ে যাবার কথা বলে পাকিস্তান অনেক জল ঘোলা করেছে, এখনো মৌলবাদীরা এই জনগোষ্ঠীকে নিয়ে রাজনীতি করে চলেছে কিন্তু এখানকার মানুষদের জীবনমান উন্নয়নে কেউই কোন উদ্যোগ নেয়নি। এইসব ভাগ্যাহত মানুষদের সবদিক বিবেচনা করে অবশেষে সরকার ঢাকার ক্যাম্পগুলোকে স্থানান্তর করে এখানকার মানুষদের দীর্ঘদিনের যে কর্মসংস্থানের ধারা তাতে বিঘ্ন না ঘটিয়ে বাসস্থানের ব্যবস্থা করার উদ্যোগ নিতে যাচ্ছে সরকার।
ভারত-পাকিস্তান বিভক্তি এবং মহান মুক্তিযুদ্ধের পর ইতিহাসের ফাঁদে আটকে কয়েক প্রজন্ম ধরে জীবন দিয়ে তার মূল্য চুকিয়ে যাচ্ছেন এই উর্দুভাষী জনগোষ্ঠী। মুক্তিযুদ্ধের পর স্বাধীন বাংলাদেশে প্রায় দুটি প্রজন্ম পেরিয়ে গেছে কিন্তু বাংলাদেশের নাগরিক হিসাবে পূর্ণ মর্যাদা, সম্মান ও সহযোগিতা পাচ্ছেন না তারা। দেশের কয়েকটি জেলায় অবস্থিত ক্যাম্পগুলোতে মানবেতর জীবন কাটাচ্ছেন তারা। আইনগত দিক থেকে আটকে পড়া পাকিস্তানীরা বাংলাদেশের নাগরিক হবার পূর্ণ স্বীকৃতি পেলেও মূলত রাজনৈতিক সিদ্ধান্তহীনতার কারণেই এই সমস্যার সমাধান হচ্ছে না। সামাজিকভাবে বাংলাদেশের উন্নতির মূলস্রোত থেকে বিচ্ছিন্ন অবস্থানে বসবাস করতে বাধ্য হচ্ছেন তারা। প্রায় সাড়ে তিন লাখ উর্দুভাষী মানুষ দেশজুড়ে বিভিন্ন ক্যাম্পে অশিক্ষা, আর্থিক অভাবে জর্জরিত হয়ে বাংলাদেশ রাষ্ট্র ও মানুষের প্রতি এক অদ্ভুত দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে প্রজন্মের পর প্রজন্ম কাটিয়ে চলেছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্প্রতি এক বৈঠকে ঢাকা শহরের মধ্যস্থলে অবস্থিত অবাঙালি বিহারিদের আবাসনের অসুবিধা, নিরাপত্তা ঝুঁকি এবং মানবিক বিষয় বিবেচনাক্রমে তাদের ঢাকার পার্শ্ববর্তী অন্য কোন সুবিধাজনক স্থানে স্থানান্তরের বিষয়ে গুরুত্বারোপ করেন। একইভাবে এ বিষয়ে কার্যকরী পদক্ষেপ নেয়ার জন্য মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ ও স্থানীয় সরকার বিভাগকেও বলা হয়। তারপর থেকেই দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের একাধিক সমন্বয় সভায় বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। বিষয়টি সমন্বয়ের জন্য ওই মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিবকে (ত্রাণ ও প্রশাসন) এ কার্যক্রম বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে জেলা প্রশাসন ও মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সঙ্গে যোগাযোগ ও সমন্বয় সাধনের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে।
স্ট্র্যান্ডেড পাকিস্তানী জেনারেল রিপার্টিশন কমিটির (এসপিজিআরসি) সূত্রে জানা যায়, রাজধানী ঢাকায় মোহাম্মদপুরের জেনেভা ক্যাম্পসহ মোহাম্মদপুর ও মিরপুরে প্রায় ৩২টি বিহারি ক্যাম্প রয়েছে। অবাঙালি বিহারি ক্যাম্পে বসবাসকারী চিহ্নিত করতে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, খুলনা, চট্টগ্রাম, বগুড়া, রাজশাহী, যশোর, জামালপুর, পাবনা, ময়মনসিংহ, রংপুর, নীলফামারী, গাইবান্ধা-এ ১৩টি জেলার জেলা প্রশাসককে চিঠি দেয়া হয়েছে। জেলা প্রশাসকদের মাধ্যমে সব জেলা থেকে অবাঙালি বিহারি পরিবারের সংখ্যা সংগ্রহ করতে বলা হয়েছে।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, অবাঙালি বিহারিদের বসবাসের ক্ষেত্রে অধিকতর সুযোগ-সুবিধা দেয়া ও মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই সরকার এমন উদ্যোগ নিয়েছে। উদ্যোগ বাস্তবায়নের ব্যাপারে জায়গা খোঁজা হচ্ছে। কিন্তু সব দিক বিবেচনায় রেখে উপযোগী জায়গা এখনো নির্ধারণ করা যায়নি। জায়গা চূড়ান্ত হলেই উদ্যোগের বাস্তবায়ন শুরু হবে।
এ প্রসঙ্গে স্ট্র্যান্ডেড পাকিস্তানী জেনারেল রিপার্টিশন কমিটির (এসপিজিআরসি) সাধারণ সম্পাদক শওকাত আলী সরকারের এ উদ্যোগকে স্বাগত জানান। তিনি বলেন, গত এপ্রিল মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করে এই অবহেলিত মানুষদের পুনর্বাসনের অনুরোধ জানাই। সে সময় তিনি কথা দিয়েছিলেন যে পুনর্বাসনের উদ্যোগ নেবেন। শওকাত আলী সরকারের কাছে শুধু ঢাকা নয় ধীরে ধীরে সারাদেশেই এ পুনর্বাসন কার্যক্রম হাতে নেয়ার আহ্বান জানান।